Friday, December 14, 2012

চেনা মাটির অচেনা গন্ধ


বাড়ির কাছে আড়াবাড়ি

প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে নিজেকে সাজাই। প্রতিনিয়ত তার নতুন নতুন সাজ। তার সেই সাজ দেখার মত সময় নেই আমাদের। কর্মচক্রে ঘুরতেই থাকি। কিন্তু এমন একটা সময় আসে যখন মন থমকে দাঁড়ায়। খোঁজে একটু বিশ্রাম---একটু আলাদা কিছু। তাই বেরিয়ে পড়া। দূরে কোথাও না হোক, কাছেপিঠেই...চেনা মাটির আচেনা গন্ধ বুক ভরে নিতে।
অরণ্যের সঙ্গে আমার সখ্যতা আজন্মের। তার টানে বার বার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি।এক
শেষ শরতে আমার লক্ষ্য ছিল বাড়ির কাছে আড়াবাড়ি—পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি ঘন শালের জঙ্গল। মেদিনীপুর শহর থেকে ৩০ কিলোমিতার উত্তরে খড়্গপুর-রাণীগঞ্জ স্টেট হাইওয়ে এই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে গেছে।আড়াবাড়ির মত অখ্যাত একটি গ্রামের নাম একদিন


সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে সুপরিকল্পিত বনসৃজনের জন্য। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশও আড়াবাড়ি ফরেস্ট রেঞ্জকে মডেল হিসাবে গণ্য করে তাদের অরণ্যসম্পদকে সম্বৃদ্ধ করে তোলে।
এই অরণ্যের উপর দিয়ে কতবারই তো গেছি কিন্তু তাকে ছুঁইয়ে দেখিনি কখনও। সেবার
কন্যার কৌতুহল চরিতার্থ করতেই নেমে পড়ি। তখনও পাতা ঝরা শুরু হয়নি। ঘনপাতায় ঢাকা জঙ্গল। বিশ হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। আমাদের কাছে খবর ছিল দলমার একদল হাতী লালগড়, পিড়াকাটা, নয়াবসত হয়ে আড়াবাড়ি ফরেস্ট রেঞ্জে ঢুকেছে।  খবরের সত্যতা যাচাই করতে ফরেস্ট অফিসের সামনে গাড়ি নিয়ে আসি। হাইওয়ের উপরেই বড় গেট। প্রশস্ত রাস্তা। ঢুকেই ডানদিকে অফিস। কয়েকজন বনকর্মী কাজ করছেন। ওদের কাছে জানতে চাইলাম জঙ্গল ঘুরে দেখতে পারি কিনা।
ওরা জানালেন --গভীর জঙ্গলে যেতে পারবেন না। তবে যেসব রাস্তায় লোকজন চলাচল করে
সেই রাস্তা ধরে ঘুরে আসতে পারেন। হাতীর দলকে তাদের হুলা পার্টি গতরাতে ঝাড়্গ্রামের জঙ্গলে তাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। তবে রাতের মধ্যে ফিরে আসা তাদের কাছে খুব বেশী কঠিন নয়।
ওরাই আমাদের সঙ্গে একজন লোক দিলেন। সে ওখানকার নার্সারিতে কাজ করে। নাম রুবিয়া মুর্মু। বনক্ররমীর ভাষায় সে জঙ্গলের কোণা কোণা চেনে।পাখির ডাক শুনে বলে দিতে পারে হাতী আছে কাছাকাছি। ওকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। দুপাশে শালের টিক। মাঝে মাঝে কেন্দু, বহেড়া, মহুয়া। বড় গাছের নীচে ছোট ছোট কুঁড়চি, পড়াশি আর ভুটরুর ঝোপ। জঙ্গলের ধারে ধারে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি আর বাঁশের সারি।মাঝে কংসাবতী প্রোজেক্টের ক্যানেল। ক্যানেলের পাড় বরাবর চওড়া রাস্তা। বড় বড় গাছের গায়ে পাক খেতে খেতে ঊপরে উঠে গেছে বুড়িলতা আর ঝুমকোলতা । কোথাও আবার আটাং ও বনলতার ঘোর অন্ধকার। বড় বড় গাছের মাথায় কুঁড়েঘরের মত ছাউনি। একবিন্দু রোদ গলে না মাটিতে। ওখাকনেই হাতীর পাল দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকে। রাত হলে নেমে যায় ধান বা ফসলের ক্ষেতে। মিস্টিগন্ধে তাকিয়ে দেখি বনলতা ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে। মউমাছির গুঞ্জনে মেতেছে বনানী।


রুবিয়া বলে---কালীপূজায় সময় লোতুন ধান উঠলে এই লতার মালা পরিয়ে গরুর বিয়া হয়।
কন্যাটি আমার হেসেই অস্থির। রুবিয়া বলে---হয় গো হয়। এটাই রীত। আমার বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে চলে আসছে। সেদিন এই লতা গলায় পরিয়ে চাঁদকে সাক্ষী রেখে গরুর বিয়া হয়।
কন্যা কৌতুকে মাতে। আমি মাতি ফুলের গন্ধে। বনের মাঝ দিয়ে গাড়ী এগিয়ে চলে। একটা খরগোশ রাস্তার এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে পালায়। আমরা হাততালি দিয়ে উঠি। রুবিয়া হাসে। ওর কাছে এসব কিছু নয়।
একসময় সে আস্তে গাড়ী চালাতে বলে। কারণ টা জানতে চাইলে মুখে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে বারণ করে। ইশারায় গাড়ী থামাতে বলে। গাড়ী থামলে হাত দিয়ে দেখায়। দূরে ঘাসের মাঝে দুটো ময়ুর। ওরা হয়ত আমাদের অস্তিত্ব বুঝতে পারল। মুহুর্তে হারিয়ে গেল ঘাসের আড়ালে। রুবিয়া বলল আমাদের ভাগ্য ভালো তাই দেখতে পেলাম। জঙ্গলের কোথায় যে ওরা থাকে কেউ জানে না। হঠাৎ করে নজরে পড়ে কারো কারো
একটু এগোতেই দেখলাম ক্যানেলের পাড় একটা জায়গায় ধ্বসে গেছে। জানলাম ওটা হাতীদের কান্ড। গতরাতে যাবার সময় এখানে ওরা পার হয়েছে। নামলাম হাতীর পায়ের ছাপ দেখতে। কন্যার পিতৃদেব মজা করেন---এটা আড়াবাড়ি। বেশী বাড়াবাড়ি কোরো না। উঠে এসো গাড়িতে।
আমরা উঠে আসি। আর একটু এগোতেই জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক।
বউ-কথা-কও, বেনে-বউ, তিতির আরও কত কি। পাতার আড়াল থেকে একটা মিস্টি শীষ ভেসে আসে। এদিক ওদিক দেখি। না কোথাও নেই। রুবিয়া বলে –ওটা একটা পাখি। ওর নাম জানিনা। বিটবাবু  বলে—বনপিয়া।
বাঃ! দারুণ তো ! ইচ্ছা হলে মনের মত নামও দেওয়া যায়। পাপিয়া-মউপিয়াদের বনতুতো বোন।
মহুল গাছের পাতায় কুক্কুটের বাসা দেখিয়ে রুবিয়া। বলে---কুক্কুটের ডিম খুব ভাল বাবু। একটুখানি ভাজা দিয়ে একথালা পান্তা খাওয়া হয়ে যায়। সকালে পেড়ে লিয়ে গেছি এতোগুলোন।
আমি ওকে দেখি। সেই অরণ্যপুত্র! জিজ্ঞাসা করি—তোমার বাড়ি কোথায়?
সে হাত দিয়ে দেখায়---হুঁই বাগে। যাবেন গো আমাদের ঘর? বউটা খুশি হবে। কুক্কুটের ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খাওয়াব আর হাড়িয়াও আছে এট্টুস।
কন্যা বলে---খাসা নিমন্ত্রণ।
তারপর সুর বদলে যায় তার---এই বন একদিন আমাদের ছিল। শালের পাতা,মহুয়ার ফল-বীজ, কুসুম তেল, কেন্দুর পাতা-ফল, কুঁচি, খেজুরপাতা...সব সব। এখন সরকারের, আমরা ওদের মজুর।
থমকে যাই। ওকে দেখি। অরণ্যের অধিকার হারানোর ব্যাথা ওর দুচোখে।কিন্তু কি করে বোঝাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে অরন্যেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
বন আরো গভীর হতে থাকে। মহুয়া, বহেড়া, শাল, কেন্দু সবাই গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।সাথে হাত মিলিয়েছে জঙ্গলের লতারা। এবার ফিরতে হবে। কোথাও কোন দলছুট থাকতে পারে। তাছাড়া এখানে নাকি ময়াল সাপ আর সজারু ছাড়া হয়েছে। বর্ষায় ক্যানেলের জলে ভেসে যেতে দেখা গেছে। আর না। ফিরে চলো মন।


ফেরার রাস্তা ধরি। ফেরার পথে রুবিয়া দেখায় পিকনিক স্পট। জঙ্গলের গায়ে পিকনিকের জায়গা।একটা ঝিল। কয়েকটা নৌকা ভাসছে। ঝিলের মাঝ পর্যন্ত যাওয়ার সেতু।  একটা শীতের দিনে পিকনিক আর ঘুরে বেড়াবার জন্য আদর্শ জায়গা। সকাল সকাল একটা গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লে মন্দ হয় না। সারাদুপুর ঘুরে ,পিকনিক করে ফেরা যায়। নাহলে বিকালে ফিল্ম সিটি দেখে সোজা গড়বেতা। রাতে লজে কাটিয়ে পরের দিন গনগনির প্রাকৃতিক দৃশ্য আর উপরিপাওনা সর্বমঙ্গলা মন্দির ও বগড়ী রাজাদের কিছু কির্তিকলাপ । খুঁজে নেওয়া যাবে হারানো ইতিহাসের কিছু পাতা। সেসব  কথা নাহয় পরে একদিন হবে।
স্টেট হাইওয়ের উপর দাঁড়িয়ে আর একবার ফিরে তাকাই জঙ্গলের দিকে। বাতাসে দুলছে আকাশমণির পাতা। হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে কি? কি জানি—হয়তো  তাই। রুবিয়ার ছেলেমেয়েকে মিঠাই খাবার জন্য কিছু দিতে যাই। সে নেয় না। বলে ---ফিরার পথে নিমন্তন্ন সেরে যাস।
তাই হবে বলে গাড়িতে উঠে বসি। আবার চলা শুরু---পিছনে পড়ে থাকে অরণ্য ও অরণ্যপুত্র।

No comments: