Friday, December 14, 2012

চেনা মাটির অচেনা গন্ধ


গড়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা

বগড়ী পরিক্রমার শুরুতেই আমরা রেখেছিলাম গড়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির। দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন  আইচ বংশের প্রথম রাজা গজপতি সিংহ। সুদৃশ্য মন্দিরটি
তৈরী করেছিলেন রাজা গজপতি কিন্তু মন্দিরটির দেবী মূর্তিটি নিয়ে একটি উপকথা প্রচলিত আছে। গজপতির রাজা হওয়ার আগে এই অঞ্চলটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং অনার্য উপজাতিদের বসবাস। তারা জঙ্গলে এক বনদেবীর পূজা করত। শিকারে যাওয়ার আগে বা পরে অথবা যুদ্ধ জয় করার পর তারা তাদের বনদেবীর সামনে তাদের শত্রু সম্প্রদায়ের একজনকে বলি দিত। রাজা গজপতি এই অনার্য উপজাতিদের ছলে বলে কৌশলে তার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। কিন্তু রাজা তাদের খুশী করার জন্য তাদের বনদেবীকে তাঁর নবনির্মিত সুদৃশ্য মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন।  সেই বনদেবীই পরে বগড়ী রাজাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা নামে পরিচি্তা হন।রাজা গজপতি মন্দিরে নরবলি বন্ধ করেন কিন্তু তাঁর অনার্য প্রজাদের খুশী রাখার জন্য নরবলির বদলে মহিষ বলি ও ছাগবলি চলু করেন। সেই প্রথা এখনও  মেনে চলা হয়। দূর্গা নবমীতে মন্দিরে মহিষবলি ও একশ আটটি ছাববলি নিয়মিত হয়ে আসছে।
দেবীর মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে এও ঘোষণা করা হয় যে গড়ের মধ্যে দেবী সর্বমঙ্গলা ছাড়া অন্য কোন প্রতিমা পূজা হবে না। এখনও গড়ের ভিতরে অন্য কোন প্রতিমার পূজা হয় না। দূর্গাপূজার সময় ষষ্ঠী থেকে বিজয়া পর্যন্ত দূর্গাপূজার মত নিয়ম মেনে দেবীর পূজা হয়। দেবী তখন দশভূজা এবং স্বর্ণালঙ্কারে শোভিতা।  প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় পূজারতি হয়। দূর দূরান্ত থেকে পূণ্যার্থীর ভীড় লেগেই থাকে।দুপুরে দেবীর ভোগান্ন রান্না হয় নিয়মিত। আগে থেকে টাকা জমা দিয়ে রাখলে ভোগান্ন মন্দির থেকে পাওয়া যায়। মন্দিরের পাশেই দেবীর রন্ধনশালা।।কথিত আছে,  মন্দিরের ভিতরে দেবী মূর্তির পিছনে একটি কূপ আছে যার জল নাকি সারা বছর কানায় কানায় পূর্ণ থাকে।পুরোহিত সেই কূপ থেকে জল তুলে পুজো করেন। এও শোনা যায় দূর্গাপূজায় অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবীর দুইপাশে জ্বলতে থাকা প্রদীপের শিখা দুটি এক হয়ে জ্বলতে থাকে।
বগড়ীর গড় ও তার সন্নিহিত অঞ্চল উপকথা ও লোককথার দেশ। এর প্রতিটি মাটিকণার মধ্যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে কত না গল্পগাথা। শুধুমাত্র সর্বমঙ্গলা মান্দির নিয়েই তো কত গল্প বগড়ীর  ঘরে ঘরে।
শুধু পেয়ে যেতে হবে মনের মত একজন গল্পবলিয়ে। আমরা পেয়েছিলাম ওখানকার পুরোহিত সিদ্ধান্ত পরিবারের একজনকে। তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন মন্দিরের গল্প। সর্বমঙ্গলা মন্দির হ’ল ভারতে একমাত্র হিন্দু মন্দির যেটি উত্তরমুখী। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাল বেতালের গল্প। পুরোহিত বলেছিলেন এই মন্দির-ও সব হিন্দু মন্দিরের মত দক্ষিণমুখী ছিল। রাজা বিক্রমাদিত্য উজ্জয়িনী থেকে এখানে এসেছিলেন তাল-বেতাল সিদ্ধ হতে। তিনি শবের উপর বসে সাধনা শুরু করেন। কতদিন কেটে গেল। একদিন দেবী সর্বমঙ্গলা তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে রাজাকে জানান যে তিনি তাঁর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন। তিনি তাল-বেতাল সিদ্ধ। তাল-বেতাল সেই মুহুর্ত থেকে তাঁর হুকুম মেনে চলবে। দেবীর এই বরের সত্যতা যাচাই করার জন্য বিক্রমাদিত্য তাল-বেতালকে আদেশ করেন মন্দিরের মুখ উত্তর দিকে ঘুরিয়ে দিতে । তাল-বেতাল সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের মুখ উত্তর দিকে করে দেয়। সেই থেকে মন্দিরটি উত্তরমুখী।
অনেকে বলেন বেতালের  নাম থেকেই এই স্থানের নাম হয় ‘বেতা’। আবার অনেকে একথাও বলেন যে, গজপতির আগে যেসব উপজাতি নেতারা বগড়ী দখল করে রেখেছিল তাদের মধ্যে কেউ শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তার রাজ্যের চারদিকে একটি গড় নির্মান করেন। আর গড়ের পাশে পাশে বেতের জঙ্গল ছিল। তার থেকে স্থানটিকে বলা হত ‘বেত্রগড় ‘ বা গড়-বেতা।
মন্দির পর্যন্ত গাড়ি চলে যায়। যাবার সময় গড় পার হয়ে যেতে হয়। গড়বেতা হাইস্কুলের ঠিক আগেই গড়ের উপর দিয়ে রাস্তা। বাইরে গাড়ি রেখে পুজোর সামগ্রী সংগ্রহ করে নিয়ে মন্দিরে ঢুকতে হয়। গেট পার হয়ে মন্দির চত্বরের ডানদিকে দেখা যায় মাটিতে পোঁতা বিশাল হাড়িকাঠ। দূর্গাপূজার সময় মহিষ ও ছাগবলি দেওয়া হয়। গেটের মাথায় সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে পূজার সময় সানাই বাজে ষষ্ঠী থেকে বিজয়া । সিঁড়ি দিয়ে উঠেই  ডানদিকে নাটমন্দির। বাঁদিকে মন্দিরের প্রধান দরজা। মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়। এই মন্দিরটিকে বলা হয় ‘মোহন’। একদিকে দেবীর রাজকীয় শয্যা, অন্যদিকে দেবীর ভোগের উপকরণ থরে থরে সাজানো। মাঝখানে দর্শনার্থীরা সারিবদ্ধভাবে পুজার জন্য দাঁড়িয়ে। এর পরের মন্দিরটিকে বলা হয় ‘দেউল’। এখানে দেবী অবস্থান করেন। কালো পাথরের মূর্তি। মাথায় মুকুট ও নাকের নথটি সকলের নজরে পড়বেই। তিনি রাজ পরিবারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সর্বাঙ্গে সোনার অলংকার। দূর্গাপূজায় এই অলংকার আরো বহুগুণ বর্ধিত হয়। বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া মন্দিরে খুব একটা ভীড় হয় না। বিজয়ার সকালে গেলে ভীড়ও থাকে না আবার দেবীর সালংকারা দশভূজা মূর্তি দেখা যায়। মন্দিরের দেওয়াল পাথরের। আদল উড়িষ্যা মন্দিরের মত। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যেহেতু পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও কোনারকের সূর্যমন্দিরের পরে পরেই এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল, তাই রাজা গজপতি খুব সহজেই উড়িষ্যা থেকে কারিগরদের এনেছিলেন। মন্দিরের গায়ে কিন্নর ও অপ্সরাগুলির কারুকাজ দেখার মত।
নাটমন্দির দিয়ে উত্তরদিকে গেলেই খিড়কি দরজার পরেই বিশাল মঙ্গলাদিঘী। গড়ের মধ্যে সাতটি বিশাল দিঘীর অন্যতম একটি।কালো জলের অতলে লুকিয়ে রেখেছে কত না উত্থান পতনের কাহিনী।     
সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে বেরয়ানোর আগে আর একবার দাঁড়িয়ে দেখি মন্দিরের ঝুলন্ত ঘণ্টাগুলিকে ও সেই বিখ্যাত হাড়িকাঠটিকে। কত বলির সাক্ষী ওরা।এরপর আমরা যাব কামেশ্বর শিবমন্দির। সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে কয়েক মিনিটের পথ। এই মন্দির থেকে একশ গজ দূরত্বে অবস্থিত। অনেকটা সর্বমঙ্গলা মন্দিরের অনুরূপ। মন্দিরের দরজার উপরে খিলানটি উল্লেখযোগ্য। চলতে চলতে এই মন্দিরের গল্প শুনে নিই। স্থানীয় লোকেরা বলে থাকেন একদিন রাজা গজপতি মনস্থ করেন তিনি সর্বমঙ্গলা মন্দিরের কাছাকাছি কোথাও একটি বৃহৎ শিবলিঙ্গ স্থাপন করবেন। রাজা যেদিন মূর্তিটি স্থাপন করবেন মনস্থ করেন সেই সময়ের মধ্যে একটি বড় শিবলঙ্গ পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, বিশেষ করে সেই সময়ের মধ্যে কাশীধাম থেকে মূর্তিটি সংগ্রহ করে ফিরে আসা যাবে না। রাজা গজপতি অস্থির হয়ে পড়লেন। বুঝতে পারছিলেন না কোথা থেকে বা কিভাবে মূর্তিটি সংগ্রহ করবেন। এই কথা যোগীবর উপেন্দ্র ভটতজীর কানে পৌঁছাতে তিনি রাজাকে আশ্বস্ত করলেন এবং তার পরিবারবর্গের সকলকে নিয়ে  নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হতে বললেন।রাজা তাঁর কথামত কাজ করলেন। ভট্টজী যোগবলে এক বিশাল শিবলিঙ্গ মাটির নীচ থেকে উত্থিত করলেন। রাজার আনন্দের সীমা রইল না। মূর্তিটিকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেখানে একটি মনোমত মন্দির নির্মাণ করলেন। সেই মূর্তিটিই কামেশ্বর শিবলিঙ্গ। ওখানকার লোকের ভাষায় বুড়োশিব। প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজন উৎসব হয়। নীলষষ্ঠীর দিন পাশের বিশাল দিঘী থেকে জল নিয়ে ভক্তরা বুড়োশিবের মাথায় ঢালে। পরদিন বাসি চড়ক। সেও এক বর্ণাঢ্য উৎসব। 
গল্প শোনা শেষ হবার আগেই আমরা মন্দিরে পৌঁছে যাই।  মন্দির ও দিঘী দুটিই ঘুরে দেখি। এছাড়াও দেখি রাধাবল্লভজীর মন্দির। মন্দিরটি বাংলা ও উড়িষ্যার স্থাপত্যশিল্পের সংমিশ্রণে নির্মিত। এই মন্দিরের নির্মাতা হলেন রাজা দুর্জন সিং মল্ল।
এর পরের দ্রষ্টব্য ছিল এতক্ষণ আমরা যে গড়ের কথা বলে আসছি সেই গড়ের দুর্গ রাইকোটা ফোর্ট—বগড়ীর রাজাদের রাজধানী ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। দূর্গের চারদিকে ছিল বিশাল মাটির গড়। তারপর পরিখা। এখনও কোথাও কোথাও সেই গড়ের নিশানা অটুট। দুর্গের চারটি দরজা  বা ফটক ছিল---লাল দরজা, রাউতা দরজা, পেশা দরজা ও হনুমান দরজা।  দুর্গের উত্তর দিকে সতটি বিশাল দিঘী —জলটুঙ্গী, ইন্দ্র পুষ্করিণী। পাথুরিয়া, হাড়ুয়া, মঙ্গলা, কবেশ দিঘী ও আম্রপুষ্করিণী। দিঘীগুলি এখনও আছে।এগুলি খনন করা হয়েছিল বগড়ীর চৌহান রাজাদের রাজত্বকালে। সম্ভবতঃ ১৫৫৫সাল থেকে ১৬১০ সালের মধ্যে। রাইকোটা দুর্গ ব্রিটিশ সেনাদের হাতে ধ্বংস হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা বড় বড় কামান দিয়ে দুর্গ ভেঙ্গে দেয়। 
দেয়। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন রাইকোটা দুর্গ আক্রমণ করার আগেই রাজপরিবারে সবাই সুড়ঙ্গপথে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যান। যাবার সময় দেবী সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি নিয়ে যেতে পারেননি। তাই দেবীর ঘট নিয়ে চল্বে  যান। সেই ঘটটিকে পুঁতে পূজা শুরু করেন। তার থেকে নতুন রাজধানীর নাম হয় মঙ্গলাপোঁতা। স্থানীয় লোকের ভাষায় মংলাপাতা।
রাইকোটা ফোর্টে দেখার কিছুই নেই। শুধু অতীত দিনের স্মৃতি বয়ে কিছু মাটির ঢিপি,খানিক নালা ও মাটির ঊঁচু গড়।
তবুও ভাঙ্গাগড়ের পাশে অতীতকে বুকে জড়িয়ে আছে রঘুনাথজীর মন্দির। শীলাবতীর দক্ষিণতীরে গনগনির ডাঙ্গায় মন্দিরটি। মন্দিরের ন’টি স্তম্ভ(নবরত্ন)। মন্দিরের গায়ে পশুপাখির প্রতিকৃতি ও পোড়ামাটির কাজ উল্লেখযোগ্য। মন্দিরটি নির্মাণ করেন আদি মল্লরাজা রঘুনাথ মল্ল।

বগড়ীর কৃষ্ণরায়জীর মন্দিরঃ- গড়বেতা স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বগড়ী কৃষ্ণনগরে শীলাবতীর তীরে মন্দিরটি আবস্থিত। পাঁচ স্তম্ভযুক্ত মন্দিরটির গঠন পুরোপুরি বাংলা ধাঁচে। মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা গজপতির সিং য়ের মন্ত্রী রাজ্যধর রায়। মূর্তিটি কালো বেসাল্টের খচিত। স্থাপত্য অতুলনীয়। দোলযাত্রা উপলক্ষে এখানে বড় মেলা হয়। দূর দূরান্ত থেকে লোকের আগমন হয়। মেলায় বিখ্যাত বিভিন্ন ডিজাইনের মাদুর ও তালপাতার পাখা।
শীলাবতীর অপর পাড়ে আরও একটি ইঁটের মন্দির ছিল। সেটি এখন শীলাবতীর বানে ভেসে গেছে।
বগড়ী  এক রূপকথার দেশ...চুপকথার দেশ। এর প্রতিটি মন্দির, মাঠ, জঙ্গল  ও নদীকে নিয়ে কত শত কাহিনী। ঘুরতে ঘুরতে যদি চলে যাওয়া যায় মংলাপাতার রাজবাড়ি –সেখানে ছড়িয়ে আছে আরও কত ইতিহাস। সময় থাকলে চলো সেখানেও উঁকি দিয়ে আসি।

No comments: