গনগনে রোদেপোড়া গনগনি
আড়াবাড়িকে পিছনে ফেলে হাইওয়ে দিয়ে
এগিয়ে চলি। সামনে কুবাই নদী। নদীর উপর সরু
ব্রীজ। হাইওয়ে আর রেললাইন একজায়গায় নদীর বাঁকে ক্রশ করেছে। রাস্তা খুব সরু। আর
বাঁকের জন্য খুব বিপজ্জনক। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। পার হতে হতে কুবাইকে দেখলাম। এখন
ক্ষীণ নদী। তিরতির করে বইছে। সামনেই চন্দ্রকোণা রোড। একটুখানি বিরতি। দুপুরের
খাওয়ার জন্য। হোটেল খুব একটা ভাল নয় । তবে রাস্তায় বেরিয়ে আমার ধাবাতে খাওয়াও
অভ্যাস আছে। একটা একটু পরিষ্কার দেখে আমরা বসে গেলাম।জায়গাটা বাসরুটের জংশন বলা
যায়। বাঁকুড়া, ঘাটাল, গোয়ালতোড় সবদিক থেকে বাস এসে মেদিনীপুর বা কোলকাতার দিকে
যায়। তাই হোটেলগুলোতে বেশ ভীড়।। তবে টাটকা খাবার। পরিবেশনও বেশ জলদি। খাবার পর
একটু ঘুরে দেখলাম বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, সবুজপাতা আর রং বেরংয়ের ফুলে ফুলেভরা
একটা পার্ক। হাতে সময় কম। তাই উঠে পড়ি গাড়িতে।
সামনে আরেক জঙ্গল। এর নাম লেদাপোল।
আড়াবাড়ির মত বিখ্যাত না হলেও এটিও দলমার দামালদের বিচরণ ক্ষেত্র। সর্বত্রই অরণ্যের
রূপ বোধহয় একই রকম---বিশেষ করে পর্ণমোচী বৃক্ষের জঙ্গল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর রসকুন্ডু মোড়ে এসে গাড়ি বাঁদিকে মোড় নেয়। গনগনি
যাওয়ার জন্য এটা সর্টকার্ট।ঊদ্দেশ্য অবশ্যই বিকেলের আলোয় রোদেপোড়া গনগনির অপরূপ
লালমাটির রং দেখে চোখ জুড়ানো আর শেষবেলার
রোদে শিলাইয়ের ঝিকিমিকি।
তাছাড়া নদীর চরে চখাচখি, কাদাখোঁচা ও সাদাবকের মেলা তো
আছেই।
কিছুটা আসার পর আবার ডানদিকের
রাস্তা ধরি। সোজা রাস্তাটা চলে গেছে গড়বেতা রেলস্টেশন । গাছগাছালির মাঝ দিয়ে চলতে
চলতে নজরে পড়ে ডানদিকে গড়বেতা কলেজ আর বাঁদিকে অচল সিংহ স্টেডিয়াম ও পার্ক।
আমাদের মন তখন গনগনির দিকেই। রাস্তা ছেড়ে কাজুবাদামের বাগানের পাশ
দিয়ে গনগনির পথে এগিয়ে যাই। ভূমিক্ষয় রোধ করতে বনবিভাগের উদ্যোগে এই কৃত্রিম বনসৃজন।
নদীর দিক থেকে হিমেল বাতাস ভেসে আসে। গাছগাছালির ভীড়ে বুনোপাখিদের ডাকাডাকি। একটা
মোহময় পরিবেশ।এখান থেকেই দেখা যায় লোকজনের ভীড়। একটা ছাউনি,কিছু ভেন্ডার। গাড়ি
থামতে না থামতেই কন্যা একদৌড়ে নদীর পাড়ে।
আমরাও সেখানেএসে দাঁড়ায় । পাড় থেকে অনেক নীচে বয়ে চলেছে শীলাবতী। দূরে
পায়রাঊড়ার রেলসেতু।একটা লোকাল ট্রেন ঝমঝমিয়ে চলে যাচ্ছে। তার হুইসেলের শব্দ ভেসে
আসছে বাতাসে।দুপাশে খাদের মত খোয়াই। লালমাটি ধুয়ে ধুয়ে নেমে গেছে নিচে। সিঁড়ি বেয়ে
নীচে নামি। নীচে নামতেই অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়---যার টানে ছুটে আসা। বর্ষার
জলে ধোওয়া শিলাইয়ের পাড় যেন প্রকৃতির আপন হাতে খোদাই করা এক এক্লটা ভাস্কর্য। এক
অপরূপ কারুকাজ। কল্পনার চোখ দিয়ে যেভাবে দেখবেন সেভাবেই ধরা পড়বে। কোনটা মনে হয়
মান্দিরের ফটক, কোনটা জীবজন্তু বা মানুষের প্রতিকৃতি। আবার কোনটা হয়তো অট্টালিকার
ঝুল বারান্দা মনে হয়। কল্পনায় যা ভাবা যায় তাই ধরা দেয় মাটির ক্যানভাসে। কন্যা
ছুটে ছুটে উঠে যায় এক একটা জায়গায়। দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে পড়ে যেন নিজেও এক মূর্তি।
আরও ভালো করে দেখার জন্য হাঁটুজল ভেঙ্গে নদীর ওপারে যাই। বালিতে বসে পড়ি। সামনে
শিলাই, ওপারে লাল ক্যানভাসে কত না বিচিত্র চিত্র। ডুবে যাই নিজের মধ্যে।
কন্যা বালির থেকে তুলে একটুকরো
হাড়ের মত শক্ত বস্তু। জানতে চায় ওটা কি। আমি হেসে বলি –বকরাক্ষসের হাড়।
কন্যা অবিশ্বাসের সুরে
বলে---ঠাত্তা করছো?
উত্তর দিই---না গল্প নয়। বিজ্ঞান
অন্য কথা বললেও আমরা ছোটবেলা থেকে এটাই শুনে আসছি।
আমাদের কথা শুনে একজন এগিয়ে এলেন।
বলেন –হ্যাঁ, জনশ্রুতি তাই বলে। আমরা ওকে বসতে বলি। গল্প শুনি---মহাভারতের গল্পে
আছে জতুগৃহ দাহের পর পান্ডবরা বারাণাবত ত্যাগ
করেন। ভাগীরথী পার হয়ে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেন। একসময় তারা একচক্রা নামে এক গ্রামে কিছুদিনের জন্য
অজ্ঞাতবাস করেন। গ্রামটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। সেই জঙ্গলে ছিল বক নামে এক রাক্ষসের
বাস। সে প্রতিদিন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রচুর খাবার ও একটি মানুষ দাবী করত।
গ্রামবাসীরা সেই শর্ত মেনে খাবার ও একজন মানুষ তার কাছে পাঠাত। এই কথা মধ্যমপান্ডব
ভীমের কানে আসে। পরের দিন খাবার নিয়ে তিনি নিজে জঙ্গলে যান। বসে বসে সব খাবার খেতে
থাকেন। তাই দেখে বক রেগে গিয়ে বড় বড় গাছ উপড়ে তাকে মারতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে ভীম
বকরাক্ষসকে হত্যা করেন।একচক্রা গ্রামের লোকেরা রক্ষা পায়। এই একচক্রা গ্রাম এপারের
একাড়া গ্রাম আর তার কাছাকাছি ভিখনগর গ্রাম হল যেখানে পান্ডবরা ভিক্ষা করতেন। আর
এখানকার লোকেরা বিশ্বাস করে যে ছড়িয়ে থাকা এইসব প্রস্তরীভূত গাছের ফসিল হল
বকরাক্ষসের হাড়।
গল্প শুনে আমরা খুশি। ওকে চা খাবার
জন্য দশটাকা দিই। কন্যা বলে ---এই ব্যাপার।
আমি বলি--- না এখানেও ইতিহাসের
গন্ধ কিছু আছে।
কন্যার পিতৃদেব তার স্বভাবসিদ্ধ
সুরে বলেন---পেশ কিজিয়ে। তবে তার আগে এককাপ চা পেলে জমে যেতো।
গল্পের আঁচ পেয়ে দুচারজন বসে
গেছেন। তাদেরই একজন চাওয়ালাকে ডেকে আনে। আমি ইতিহাসের পাতা হাতড়াতে থাকি।
স্মরণাতীত কাল থেকে এই অঞ্চলে বাস
করত এক অনার্য উপজাতি।এমন কি আর্য সভ্যতা
বিস্তার লাভ করলেও তাদের উপরে তার
কোন প্রভাব পড়েনি।আর্যরা তাদের নিম্নবর্ণের হিন্দু বলেই গন্য করত। সমাজ থেকে দূরে
জঙ্গলের মাঝেই বাস করত তারা। তাদের এক দলনেতা ছিল বক। সম্ভবত সেটা মহাভারতের যুগ।
আর্যরা এই উপজাতি দলনেতাকে বকরাক্ষস বা বকাসুর নামে অভিহিত করত। সেই যুগে অনার্যদের
মধ্যে এই রীতি প্রচলিত ছিল যে তারা শিকারে যাবার আগে বা পরে তাদের বনদেবীর সামনে
একটি মানুষকে বলি দিত (নিশ্চিত যে সে অবশ্যই তাদের সম্প্রদায়ের শত্রু)। তাদের শত্রু যে আর্যরা ছিল
তাতে কোন সন্দেহ নেই।আর্যরা তাই তাদের অসুর বা রাক্ষস বলত।আর্যবীর ভীমসেন বকাসুরকে বধ করেন। হয়তো তখন
থেকেই বনদেবীর সামনে নরবলি দেওয়ার প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। বকাসুরের নাম থেকেই এই
অঞ্চলের নাম হয় বকডিহি বা বগড়ী। আর এখানে বসবাসকারী অনার্য উপজাতির নাম বাগদী।
বালুচরে পাখিদের মেলা বসে গেছে।
ছোটাছুটি ,লাফালাফি, কিচিরমিচির। পায়রাউড়ার রেলপুলের ওপারে আকাশটা লাল হয়ে
উঠেছে।তার ছায়া পড়েছে শীলাবতীর জলে, পাড়ের লালমাটিতে। ভাবি গনগনির মাটি এত লাল
কেন? হয়তো অনেক রক্তঝরা দেখে দেখে সে এত লাল। কন্যার অনুযোগ--- কি ভাবছো?
ভাবছি এ মাটি এত লাল কেন?
কেন শুনি।
আমি জানি---বলে উঠল একজন। তাকিয়ে
দেখি নতুন প্রজন্ম। সবাই বলে---বলো,বলো।
শুরু হয় বলা।
বগড়ী ছিল কোম্পানীর আমলে বাংলার
শেষ স্বাধীন রাজ্য। শেষ রাজা ছিলেন ছত্র সিংহ। বগড়ীর গড় ধ্বংস করেছে ব্রিটিশ। নতুন
রাজধানী মঙ্গলাপোঁতায় বাস রাজার। লায়েক বিদ্রোহের শেষ পর্যায়। বিদ্রোহের শুরুতে
রাজা ছিলেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে কিন্তু পরে তিনি সরে দাঁড়ালেন। হাত মেলালেন
ব্রিটিশদের সঙ্গে। অচল সিংহকে ধরিয়ে
দেবেন। কিন্তু ব্রিটিশ তাঁকে বিশ্বাস করল না। তাঁকে হুগলী জেলে বন্দী করল। শর্ত
দিল যারা লড়াই করছে, বনে জঙ্গলে লুকিয়ে
আছে তাদের সকলকে ধরিয়ে দিতে হবে। তবেই রাজা ফিরতে পারবেন তার রাজধানী
মঙ্গলাপোঁতায়। অচল সিংহ ধরা পড়লেন। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। ধরা পড়লেন আরও উনিশ জন
নেতা ও দুশ জন তাদের অনুগামী। তাদের
মৃত্যুদণ্ড অথবা ফাঁসি হয়। শোনা তাদের অনেকেরই ফাঁসি হয়েছিল গনগনির
ডাঙ্গায়। তাদের রক্তে স্নান করে এই মাটি এতো লাল। হয়তো তাই। সত্যাসত্য জানে
ইতিহাস।
কাজুবাদামের মাথা ছুঁয়ে সুর্য
হারিয়ে যেতে থাকে। পাখিরা ফিরে যায় আপন নীড়ে। আমাদেরও ফেরার পালা। চায় একটু
বিশ্রাম।
পরদিন তো বগড়ী পরিক্রমা।
No comments:
Post a Comment