Friday, December 14, 2012
চেনা মাটির অচেনা গন্ধ
গড়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা
বগড়ী পরিক্রমার শুরুতেই আমরা
রেখেছিলাম গড়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির। দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন আইচ বংশের প্রথম রাজা গজপতি সিংহ।
সুদৃশ্য মন্দিরটি
তৈরী করেছিলেন রাজা গজপতি কিন্তু
মন্দিরটির দেবী মূর্তিটি নিয়ে একটি উপকথা প্রচলিত আছে। গজপতির রাজা হওয়ার আগে এই
অঞ্চলটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং অনার্য উপজাতিদের বসবাস। তারা জঙ্গলে এক বনদেবীর পূজা
করত। শিকারে যাওয়ার আগে বা পরে অথবা যুদ্ধ জয় করার পর তারা তাদের বনদেবীর সামনে
তাদের শত্রু সম্প্রদায়ের একজনকে বলি দিত। রাজা গজপতি এই অনার্য উপজাতিদের ছলে বলে
কৌশলে তার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। কিন্তু রাজা তাদের খুশী করার জন্য
তাদের বনদেবীকে তাঁর নবনির্মিত সুদৃশ্য মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বনদেবীই পরে বগড়ী রাজাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী
সর্বমঙ্গলা নামে পরিচি্তা হন।রাজা গজপতি মন্দিরে নরবলি বন্ধ করেন কিন্তু তাঁর
অনার্য প্রজাদের খুশী রাখার জন্য নরবলির বদলে মহিষ বলি ও ছাগবলি চলু করেন। সেই
প্রথা এখনও মেনে চলা হয়। দূর্গা নবমীতে
মন্দিরে মহিষবলি ও একশ আটটি ছাববলি নিয়মিত হয়ে আসছে।
দেবীর মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠার
সাথে সাথে এও ঘোষণা করা হয় যে গড়ের মধ্যে দেবী সর্বমঙ্গলা ছাড়া অন্য কোন প্রতিমা
পূজা হবে না। এখনও গড়ের ভিতরে অন্য কোন প্রতিমার পূজা হয় না। দূর্গাপূজার সময়
ষষ্ঠী থেকে বিজয়া পর্যন্ত দূর্গাপূজার মত নিয়ম মেনে দেবীর পূজা হয়। দেবী তখন
দশভূজা এবং স্বর্ণালঙ্কারে শোভিতা। প্রতিদিন
সকাল সন্ধ্যায় পূজারতি হয়। দূর দূরান্ত থেকে পূণ্যার্থীর ভীড় লেগেই থাকে।দুপুরে
দেবীর ভোগান্ন রান্না হয় নিয়মিত। আগে থেকে টাকা জমা দিয়ে রাখলে ভোগান্ন মন্দির
থেকে পাওয়া যায়। মন্দিরের পাশেই দেবীর রন্ধনশালা।।কথিত আছে, মন্দিরের ভিতরে দেবী মূর্তির পিছনে একটি কূপ
আছে যার জল নাকি সারা বছর কানায় কানায় পূর্ণ থাকে।পুরোহিত সেই কূপ থেকে জল তুলে
পুজো করেন। এও শোনা যায় দূর্গাপূজায় অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবীর দুইপাশে
জ্বলতে থাকা প্রদীপের শিখা দুটি এক হয়ে জ্বলতে থাকে।
বগড়ীর গড় ও তার সন্নিহিত অঞ্চল
উপকথা ও লোককথার দেশ। এর প্রতিটি মাটিকণার মধ্যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে কত না
গল্পগাথা। শুধুমাত্র সর্বমঙ্গলা মান্দির নিয়েই তো কত গল্প বগড়ীর ঘরে ঘরে।
শুধু পেয়ে যেতে হবে মনের মত একজন
গল্পবলিয়ে। আমরা পেয়েছিলাম ওখানকার পুরোহিত সিদ্ধান্ত পরিবারের একজনকে। তিনি
আমাদের শুনিয়েছিলেন মন্দিরের গল্প। সর্বমঙ্গলা মন্দির হ’ল ভারতে একমাত্র হিন্দু
মন্দির যেটি উত্তরমুখী। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাল বেতালের গল্প। পুরোহিত বলেছিলেন এই
মন্দির-ও সব হিন্দু মন্দিরের মত দক্ষিণমুখী ছিল। রাজা বিক্রমাদিত্য উজ্জয়িনী থেকে
এখানে এসেছিলেন তাল-বেতাল সিদ্ধ হতে। তিনি শবের উপর বসে সাধনা শুরু করেন। কতদিন
কেটে গেল। একদিন দেবী সর্বমঙ্গলা তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে রাজাকে জানান যে তিনি তাঁর
সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন। তিনি তাল-বেতাল সিদ্ধ। তাল-বেতাল সেই মুহুর্ত থেকে তাঁর
হুকুম মেনে চলবে। দেবীর এই বরের সত্যতা যাচাই করার জন্য বিক্রমাদিত্য তাল-বেতালকে
আদেশ করেন মন্দিরের মুখ উত্তর দিকে ঘুরিয়ে দিতে । তাল-বেতাল সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের
মুখ উত্তর দিকে করে দেয়। সেই থেকে মন্দিরটি উত্তরমুখী।
অনেকে বলেন বেতালের নাম থেকেই এই স্থানের নাম হয় ‘বেতা’। আবার
অনেকে একথাও বলেন যে, গজপতির আগে যেসব উপজাতি নেতারা বগড়ী দখল করে রেখেছিল তাদের
মধ্যে কেউ শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তার রাজ্যের চারদিকে একটি গড়
নির্মান করেন। আর গড়ের পাশে পাশে বেতের জঙ্গল ছিল। তার থেকে স্থানটিকে বলা হত
‘বেত্রগড় ‘ বা গড়-বেতা।
মন্দির পর্যন্ত গাড়ি চলে যায়।
যাবার সময় গড় পার হয়ে যেতে হয়। গড়বেতা হাইস্কুলের ঠিক আগেই গড়ের উপর দিয়ে রাস্তা।
বাইরে গাড়ি রেখে পুজোর সামগ্রী সংগ্রহ করে নিয়ে মন্দিরে ঢুকতে হয়। গেট পার হয়ে
মন্দির চত্বরের ডানদিকে দেখা যায় মাটিতে পোঁতা বিশাল হাড়িকাঠ। দূর্গাপূজার সময়
মহিষ ও ছাগবলি দেওয়া হয়। গেটের মাথায় সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে পূজার সময় সানাই বাজে
ষষ্ঠী থেকে বিজয়া । সিঁড়ি দিয়ে উঠেই
ডানদিকে নাটমন্দির। বাঁদিকে মন্দিরের প্রধান দরজা। মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়।
এই মন্দিরটিকে বলা হয় ‘মোহন’। একদিকে দেবীর রাজকীয় শয্যা, অন্যদিকে দেবীর ভোগের
উপকরণ থরে থরে সাজানো। মাঝখানে দর্শনার্থীরা সারিবদ্ধভাবে পুজার জন্য দাঁড়িয়ে। এর
পরের মন্দিরটিকে বলা হয় ‘দেউল’। এখানে দেবী অবস্থান করেন। কালো পাথরের মূর্তি।
মাথায় মুকুট ও নাকের নথটি সকলের নজরে পড়বেই। তিনি রাজ পরিবারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
সর্বাঙ্গে সোনার অলংকার। দূর্গাপূজায় এই অলংকার আরো বহুগুণ বর্ধিত হয়। বিশেষ বিশেষ
দিন ছাড়া মন্দিরে খুব একটা ভীড় হয় না। বিজয়ার সকালে গেলে ভীড়ও থাকে না আবার দেবীর
সালংকারা দশভূজা মূর্তি দেখা যায়। মন্দিরের দেওয়াল পাথরের। আদল উড়িষ্যা মন্দিরের
মত। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যেহেতু পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও কোনারকের সূর্যমন্দিরের
পরে পরেই এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল, তাই রাজা গজপতি খুব সহজেই উড়িষ্যা থেকে
কারিগরদের এনেছিলেন। মন্দিরের গায়ে কিন্নর ও অপ্সরাগুলির কারুকাজ দেখার মত।
নাটমন্দির দিয়ে উত্তরদিকে গেলেই
খিড়কি দরজার পরেই বিশাল মঙ্গলাদিঘী। গড়ের মধ্যে সাতটি বিশাল দিঘীর অন্যতম
একটি।কালো জলের অতলে লুকিয়ে রেখেছে কত না উত্থান পতনের কাহিনী।
সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে বেরয়ানোর
আগে আর একবার দাঁড়িয়ে দেখি মন্দিরের ঝুলন্ত ঘণ্টাগুলিকে
ও সেই বিখ্যাত হাড়িকাঠটিকে। কত বলির সাক্ষী ওরা।এরপর আমরা যাব কামেশ্বর শিবমন্দির।
সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে কয়েক মিনিটের পথ। এই মন্দির থেকে একশ গজ দূরত্বে অবস্থিত।
অনেকটা সর্বমঙ্গলা মন্দিরের অনুরূপ। মন্দিরের দরজার উপরে খিলানটি উল্লেখযোগ্য। চলতে
চলতে এই মন্দিরের গল্প শুনে নিই। স্থানীয় লোকেরা বলে থাকেন একদিন রাজা গজপতি মনস্থ
করেন তিনি সর্বমঙ্গলা মন্দিরের কাছাকাছি কোথাও একটি বৃহৎ শিবলিঙ্গ স্থাপন করবেন।
রাজা যেদিন মূর্তিটি স্থাপন করবেন মনস্থ করেন সেই সময়ের মধ্যে একটি বড় শিবলঙ্গ
পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, বিশেষ করে সেই সময়ের মধ্যে কাশীধাম থেকে মূর্তিটি সংগ্রহ
করে ফিরে আসা যাবে না। রাজা গজপতি অস্থির হয়ে পড়লেন। বুঝতে পারছিলেন না কোথা থেকে
বা কিভাবে মূর্তিটি সংগ্রহ করবেন। এই কথা যোগীবর উপেন্দ্র ভটতজীর কানে পৌঁছাতে
তিনি রাজাকে আশ্বস্ত করলেন এবং তার পরিবারবর্গের সকলকে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হতে
বললেন।রাজা তাঁর কথামত কাজ করলেন। ভট্টজী যোগবলে এক বিশাল শিবলিঙ্গ মাটির নীচ থেকে
উত্থিত করলেন। রাজার আনন্দের সীমা রইল না। মূর্তিটিকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন।
সেখানে একটি মনোমত মন্দির নির্মাণ করলেন। সেই মূর্তিটিই কামেশ্বর শিবলিঙ্গ।
ওখানকার লোকের ভাষায় বুড়োশিব। প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজন উৎসব হয়। নীলষষ্ঠীর
দিন পাশের বিশাল দিঘী থেকে জল নিয়ে ভক্তরা বুড়োশিবের মাথায় ঢালে। পরদিন বাসি চড়ক।
সেও এক বর্ণাঢ্য উৎসব।
গল্প শোনা শেষ হবার আগেই আমরা
মন্দিরে পৌঁছে যাই। মন্দির ও দিঘী দুটিই
ঘুরে দেখি। এছাড়াও দেখি রাধাবল্লভজীর মন্দির। মন্দিরটি বাংলা ও উড়িষ্যার
স্থাপত্যশিল্পের সংমিশ্রণে নির্মিত। এই মন্দিরের নির্মাতা হলেন রাজা দুর্জন সিং
মল্ল।
এর পরের দ্রষ্টব্য ছিল এতক্ষণ আমরা যে গড়ের কথা বলে
আসছি সেই গড়ের দুর্গ রাইকোটা ফোর্ট—বগড়ীর রাজাদের রাজধানী ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।
দূর্গের চারদিকে ছিল বিশাল মাটির গড়। তারপর পরিখা। এখনও কোথাও কোথাও সেই গড়ের
নিশানা অটুট। দুর্গের চারটি দরজা বা ফটক
ছিল---লাল দরজা, রাউতা দরজা, পেশা দরজা ও হনুমান দরজা। দুর্গের উত্তর দিকে সতটি বিশাল দিঘী —জলটুঙ্গী,
ইন্দ্র পুষ্করিণী। পাথুরিয়া, হাড়ুয়া, মঙ্গলা, কবেশ দিঘী ও আম্রপুষ্করিণী। দিঘীগুলি
এখনও আছে।এগুলি খনন করা হয়েছিল বগড়ীর চৌহান রাজাদের রাজত্বকালে। সম্ভবতঃ ১৫৫৫সাল
থেকে ১৬১০ সালের মধ্যে। রাইকোটা দুর্গ ব্রিটিশ সেনাদের হাতে ধ্বংস হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা
বড় বড় কামান দিয়ে দুর্গ ভেঙ্গে দেয়।
দেয়। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন রাইকোটা
দুর্গ আক্রমণ করার আগেই রাজপরিবারে সবাই সুড়ঙ্গপথে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যান। যাবার
সময় দেবী সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি নিয়ে যেতে পারেননি। তাই দেবীর ঘট নিয়ে চল্বে যান। সেই ঘটটিকে পুঁতে পূজা শুরু করেন। তার
থেকে নতুন রাজধানীর নাম হয় মঙ্গলাপোঁতা। স্থানীয় লোকের ভাষায় মংলাপাতা।
রাইকোটা ফোর্টে দেখার কিছুই নেই।
শুধু অতীত দিনের স্মৃতি বয়ে কিছু মাটির ঢিপি,খানিক নালা ও মাটির ঊঁচু গড়।
তবুও ভাঙ্গাগড়ের পাশে অতীতকে বুকে
জড়িয়ে আছে রঘুনাথজীর মন্দির। শীলাবতীর দক্ষিণতীরে গনগনির ডাঙ্গায় মন্দিরটি।
মন্দিরের ন’টি স্তম্ভ(নবরত্ন)। মন্দিরের গায়ে পশুপাখির প্রতিকৃতি ও পোড়ামাটির কাজ
উল্লেখযোগ্য। মন্দিরটি নির্মাণ করেন আদি মল্লরাজা রঘুনাথ মল্ল।
বগড়ীর কৃষ্ণরায়জীর মন্দিরঃ- গড়বেতা
স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বগড়ী কৃষ্ণনগরে শীলাবতীর তীরে মন্দিরটি আবস্থিত।
পাঁচ স্তম্ভযুক্ত মন্দিরটির গঠন পুরোপুরি বাংলা ধাঁচে। মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা
গজপতির সিং য়ের মন্ত্রী রাজ্যধর রায়। মূর্তিটি কালো বেসাল্টের খচিত। স্থাপত্য
অতুলনীয়। দোলযাত্রা উপলক্ষে এখানে বড় মেলা হয়। দূর দূরান্ত থেকে লোকের আগমন হয়।
মেলায় বিখ্যাত বিভিন্ন ডিজাইনের মাদুর ও তালপাতার পাখা।
শীলাবতীর অপর পাড়ে আরও একটি ইঁটের
মন্দির ছিল। সেটি এখন শীলাবতীর বানে ভেসে গেছে।
বগড়ী এক রূপকথার দেশ...চুপকথার দেশ। এর প্রতিটি মন্দির,
মাঠ, জঙ্গল ও নদীকে নিয়ে কত শত কাহিনী।
ঘুরতে ঘুরতে যদি চলে যাওয়া যায় মংলাপাতার রাজবাড়ি –সেখানে ছড়িয়ে আছে আরও কত
ইতিহাস। সময় থাকলে চলো সেখানেও উঁকি দিয়ে আসি।
চেনা মাটির অচেনা গন্ধ
গনগনে রোদেপোড়া গনগনি
আড়াবাড়িকে পিছনে ফেলে হাইওয়ে দিয়ে
এগিয়ে চলি। সামনে কুবাই নদী। নদীর উপর সরু
ব্রীজ। হাইওয়ে আর রেললাইন একজায়গায় নদীর বাঁকে ক্রশ করেছে। রাস্তা খুব সরু। আর
বাঁকের জন্য খুব বিপজ্জনক। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। পার হতে হতে কুবাইকে দেখলাম। এখন
ক্ষীণ নদী। তিরতির করে বইছে। সামনেই চন্দ্রকোণা রোড। একটুখানি বিরতি। দুপুরের
খাওয়ার জন্য। হোটেল খুব একটা ভাল নয় । তবে রাস্তায় বেরিয়ে আমার ধাবাতে খাওয়াও
অভ্যাস আছে। একটা একটু পরিষ্কার দেখে আমরা বসে গেলাম।জায়গাটা বাসরুটের জংশন বলা
যায়। বাঁকুড়া, ঘাটাল, গোয়ালতোড় সবদিক থেকে বাস এসে মেদিনীপুর বা কোলকাতার দিকে
যায়। তাই হোটেলগুলোতে বেশ ভীড়।। তবে টাটকা খাবার। পরিবেশনও বেশ জলদি। খাবার পর
একটু ঘুরে দেখলাম বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, সবুজপাতা আর রং বেরংয়ের ফুলে ফুলেভরা
একটা পার্ক। হাতে সময় কম। তাই উঠে পড়ি গাড়িতে।
সামনে আরেক জঙ্গল। এর নাম লেদাপোল।
আড়াবাড়ির মত বিখ্যাত না হলেও এটিও দলমার দামালদের বিচরণ ক্ষেত্র। সর্বত্রই অরণ্যের
রূপ বোধহয় একই রকম---বিশেষ করে পর্ণমোচী বৃক্ষের জঙ্গল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর রসকুন্ডু মোড়ে এসে গাড়ি বাঁদিকে মোড় নেয়। গনগনি
যাওয়ার জন্য এটা সর্টকার্ট।ঊদ্দেশ্য অবশ্যই বিকেলের আলোয় রোদেপোড়া গনগনির অপরূপ
লালমাটির রং দেখে চোখ জুড়ানো আর শেষবেলার
রোদে শিলাইয়ের ঝিকিমিকি।
তাছাড়া নদীর চরে চখাচখি, কাদাখোঁচা ও সাদাবকের মেলা তো
আছেই।
কিছুটা আসার পর আবার ডানদিকের
রাস্তা ধরি। সোজা রাস্তাটা চলে গেছে গড়বেতা রেলস্টেশন । গাছগাছালির মাঝ দিয়ে চলতে
চলতে নজরে পড়ে ডানদিকে গড়বেতা কলেজ আর বাঁদিকে অচল সিংহ স্টেডিয়াম ও পার্ক।
আমাদের মন তখন গনগনির দিকেই। রাস্তা ছেড়ে কাজুবাদামের বাগানের পাশ
দিয়ে গনগনির পথে এগিয়ে যাই। ভূমিক্ষয় রোধ করতে বনবিভাগের উদ্যোগে এই কৃত্রিম বনসৃজন।
নদীর দিক থেকে হিমেল বাতাস ভেসে আসে। গাছগাছালির ভীড়ে বুনোপাখিদের ডাকাডাকি। একটা
মোহময় পরিবেশ।এখান থেকেই দেখা যায় লোকজনের ভীড়। একটা ছাউনি,কিছু ভেন্ডার। গাড়ি
থামতে না থামতেই কন্যা একদৌড়ে নদীর পাড়ে।
আমরাও সেখানেএসে দাঁড়ায় । পাড় থেকে অনেক নীচে বয়ে চলেছে শীলাবতী। দূরে
পায়রাঊড়ার রেলসেতু।একটা লোকাল ট্রেন ঝমঝমিয়ে চলে যাচ্ছে। তার হুইসেলের শব্দ ভেসে
আসছে বাতাসে।দুপাশে খাদের মত খোয়াই। লালমাটি ধুয়ে ধুয়ে নেমে গেছে নিচে। সিঁড়ি বেয়ে
নীচে নামি। নীচে নামতেই অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়---যার টানে ছুটে আসা। বর্ষার
জলে ধোওয়া শিলাইয়ের পাড় যেন প্রকৃতির আপন হাতে খোদাই করা এক এক্লটা ভাস্কর্য। এক
অপরূপ কারুকাজ। কল্পনার চোখ দিয়ে যেভাবে দেখবেন সেভাবেই ধরা পড়বে। কোনটা মনে হয়
মান্দিরের ফটক, কোনটা জীবজন্তু বা মানুষের প্রতিকৃতি। আবার কোনটা হয়তো অট্টালিকার
ঝুল বারান্দা মনে হয়। কল্পনায় যা ভাবা যায় তাই ধরা দেয় মাটির ক্যানভাসে। কন্যা
ছুটে ছুটে উঠে যায় এক একটা জায়গায়। দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে পড়ে যেন নিজেও এক মূর্তি।
আরও ভালো করে দেখার জন্য হাঁটুজল ভেঙ্গে নদীর ওপারে যাই। বালিতে বসে পড়ি। সামনে
শিলাই, ওপারে লাল ক্যানভাসে কত না বিচিত্র চিত্র। ডুবে যাই নিজের মধ্যে।
কন্যা বালির থেকে তুলে একটুকরো
হাড়ের মত শক্ত বস্তু। জানতে চায় ওটা কি। আমি হেসে বলি –বকরাক্ষসের হাড়।
কন্যা অবিশ্বাসের সুরে
বলে---ঠাত্তা করছো?
উত্তর দিই---না গল্প নয়। বিজ্ঞান
অন্য কথা বললেও আমরা ছোটবেলা থেকে এটাই শুনে আসছি।
আমাদের কথা শুনে একজন এগিয়ে এলেন।
বলেন –হ্যাঁ, জনশ্রুতি তাই বলে। আমরা ওকে বসতে বলি। গল্প শুনি---মহাভারতের গল্পে
আছে জতুগৃহ দাহের পর পান্ডবরা বারাণাবত ত্যাগ
করেন। ভাগীরথী পার হয়ে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেন। একসময় তারা একচক্রা নামে এক গ্রামে কিছুদিনের জন্য
অজ্ঞাতবাস করেন। গ্রামটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। সেই জঙ্গলে ছিল বক নামে এক রাক্ষসের
বাস। সে প্রতিদিন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রচুর খাবার ও একটি মানুষ দাবী করত।
গ্রামবাসীরা সেই শর্ত মেনে খাবার ও একজন মানুষ তার কাছে পাঠাত। এই কথা মধ্যমপান্ডব
ভীমের কানে আসে। পরের দিন খাবার নিয়ে তিনি নিজে জঙ্গলে যান। বসে বসে সব খাবার খেতে
থাকেন। তাই দেখে বক রেগে গিয়ে বড় বড় গাছ উপড়ে তাকে মারতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে ভীম
বকরাক্ষসকে হত্যা করেন।একচক্রা গ্রামের লোকেরা রক্ষা পায়। এই একচক্রা গ্রাম এপারের
একাড়া গ্রাম আর তার কাছাকাছি ভিখনগর গ্রাম হল যেখানে পান্ডবরা ভিক্ষা করতেন। আর
এখানকার লোকেরা বিশ্বাস করে যে ছড়িয়ে থাকা এইসব প্রস্তরীভূত গাছের ফসিল হল
বকরাক্ষসের হাড়।
গল্প শুনে আমরা খুশি। ওকে চা খাবার
জন্য দশটাকা দিই। কন্যা বলে ---এই ব্যাপার।
আমি বলি--- না এখানেও ইতিহাসের
গন্ধ কিছু আছে।
কন্যার পিতৃদেব তার স্বভাবসিদ্ধ
সুরে বলেন---পেশ কিজিয়ে। তবে তার আগে এককাপ চা পেলে জমে যেতো।
গল্পের আঁচ পেয়ে দুচারজন বসে
গেছেন। তাদেরই একজন চাওয়ালাকে ডেকে আনে। আমি ইতিহাসের পাতা হাতড়াতে থাকি।
স্মরণাতীত কাল থেকে এই অঞ্চলে বাস
করত এক অনার্য উপজাতি।এমন কি আর্য সভ্যতা
বিস্তার লাভ করলেও তাদের উপরে তার
কোন প্রভাব পড়েনি।আর্যরা তাদের নিম্নবর্ণের হিন্দু বলেই গন্য করত। সমাজ থেকে দূরে
জঙ্গলের মাঝেই বাস করত তারা। তাদের এক দলনেতা ছিল বক। সম্ভবত সেটা মহাভারতের যুগ।
আর্যরা এই উপজাতি দলনেতাকে বকরাক্ষস বা বকাসুর নামে অভিহিত করত। সেই যুগে অনার্যদের
মধ্যে এই রীতি প্রচলিত ছিল যে তারা শিকারে যাবার আগে বা পরে তাদের বনদেবীর সামনে
একটি মানুষকে বলি দিত (নিশ্চিত যে সে অবশ্যই তাদের সম্প্রদায়ের শত্রু)। তাদের শত্রু যে আর্যরা ছিল
তাতে কোন সন্দেহ নেই।আর্যরা তাই তাদের অসুর বা রাক্ষস বলত।আর্যবীর ভীমসেন বকাসুরকে বধ করেন। হয়তো তখন
থেকেই বনদেবীর সামনে নরবলি দেওয়ার প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। বকাসুরের নাম থেকেই এই
অঞ্চলের নাম হয় বকডিহি বা বগড়ী। আর এখানে বসবাসকারী অনার্য উপজাতির নাম বাগদী।
বালুচরে পাখিদের মেলা বসে গেছে।
ছোটাছুটি ,লাফালাফি, কিচিরমিচির। পায়রাউড়ার রেলপুলের ওপারে আকাশটা লাল হয়ে
উঠেছে।তার ছায়া পড়েছে শীলাবতীর জলে, পাড়ের লালমাটিতে। ভাবি গনগনির মাটি এত লাল
কেন? হয়তো অনেক রক্তঝরা দেখে দেখে সে এত লাল। কন্যার অনুযোগ--- কি ভাবছো?
ভাবছি এ মাটি এত লাল কেন?
কেন শুনি।
আমি জানি---বলে উঠল একজন। তাকিয়ে
দেখি নতুন প্রজন্ম। সবাই বলে---বলো,বলো।
শুরু হয় বলা।
বগড়ী ছিল কোম্পানীর আমলে বাংলার
শেষ স্বাধীন রাজ্য। শেষ রাজা ছিলেন ছত্র সিংহ। বগড়ীর গড় ধ্বংস করেছে ব্রিটিশ। নতুন
রাজধানী মঙ্গলাপোঁতায় বাস রাজার। লায়েক বিদ্রোহের শেষ পর্যায়। বিদ্রোহের শুরুতে
রাজা ছিলেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে কিন্তু পরে তিনি সরে দাঁড়ালেন। হাত মেলালেন
ব্রিটিশদের সঙ্গে। অচল সিংহকে ধরিয়ে
দেবেন। কিন্তু ব্রিটিশ তাঁকে বিশ্বাস করল না। তাঁকে হুগলী জেলে বন্দী করল। শর্ত
দিল যারা লড়াই করছে, বনে জঙ্গলে লুকিয়ে
আছে তাদের সকলকে ধরিয়ে দিতে হবে। তবেই রাজা ফিরতে পারবেন তার রাজধানী
মঙ্গলাপোঁতায়। অচল সিংহ ধরা পড়লেন। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। ধরা পড়লেন আরও উনিশ জন
নেতা ও দুশ জন তাদের অনুগামী। তাদের
মৃত্যুদণ্ড অথবা ফাঁসি হয়। শোনা তাদের অনেকেরই ফাঁসি হয়েছিল গনগনির
ডাঙ্গায়। তাদের রক্তে স্নান করে এই মাটি এতো লাল। হয়তো তাই। সত্যাসত্য জানে
ইতিহাস।
কাজুবাদামের মাথা ছুঁয়ে সুর্য
হারিয়ে যেতে থাকে। পাখিরা ফিরে যায় আপন নীড়ে। আমাদেরও ফেরার পালা। চায় একটু
বিশ্রাম।
পরদিন তো বগড়ী পরিক্রমা।
চেনা মাটির অচেনা গন্ধ
বাড়ির কাছে আড়াবাড়ি
প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে নিজেকে
সাজাই। প্রতিনিয়ত তার নতুন নতুন সাজ। তার সেই সাজ দেখার মত সময় নেই আমাদের।
কর্মচক্রে ঘুরতেই থাকি। কিন্তু এমন একটা সময় আসে যখন মন থমকে দাঁড়ায়। খোঁজে একটু
বিশ্রাম---একটু আলাদা কিছু। তাই বেরিয়ে পড়া। দূরে কোথাও না হোক, কাছেপিঠেই...চেনা
মাটির আচেনা গন্ধ বুক ভরে নিতে।
অরণ্যের সঙ্গে আমার সখ্যতা
আজন্মের। তার টানে বার বার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি।এক
শেষ শরতে আমার লক্ষ্য ছিল বাড়ির
কাছে আড়াবাড়ি—পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি ঘন শালের জঙ্গল। মেদিনীপুর শহর থেকে ৩০
কিলোমিতার উত্তরে খড়্গপুর-রাণীগঞ্জ স্টেট হাইওয়ে এই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে
গেছে।আড়াবাড়ির মত অখ্যাত একটি গ্রামের নাম একদিন
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে সুপরিকল্পিত
বনসৃজনের জন্য। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন
দেশও আড়াবাড়ি ফরেস্ট রেঞ্জকে মডেল হিসাবে গণ্য করে তাদের অরণ্যসম্পদকে সম্বৃদ্ধ
করে তোলে।
এই অরণ্যের উপর দিয়ে কতবারই তো
গেছি কিন্তু তাকে ছুঁইয়ে দেখিনি কখনও। সেবার
কন্যার কৌতুহল চরিতার্থ করতেই নেমে
পড়ি। তখনও পাতা ঝরা শুরু হয়নি। ঘনপাতায় ঢাকা জঙ্গল। বিশ হাত দূরের কিছু দেখা যায় না।
আমাদের কাছে খবর ছিল দলমার একদল হাতী লালগড়, পিড়াকাটা, নয়াবসত হয়ে আড়াবাড়ি ফরেস্ট
রেঞ্জে ঢুকেছে। খবরের সত্যতা যাচাই করতে
ফরেস্ট অফিসের সামনে গাড়ি নিয়ে আসি। হাইওয়ের উপরেই বড় গেট। প্রশস্ত রাস্তা। ঢুকেই
ডানদিকে অফিস। কয়েকজন বনকর্মী কাজ করছেন। ওদের কাছে জানতে চাইলাম জঙ্গল ঘুরে দেখতে
পারি কিনা।
ওরা জানালেন --গভীর জঙ্গলে যেতে
পারবেন না। তবে যেসব রাস্তায় লোকজন চলাচল করে
সেই রাস্তা ধরে ঘুরে আসতে পারেন।
হাতীর দলকে তাদের হুলা পার্টি গতরাতে ঝাড়্গ্রামের জঙ্গলে তাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। তবে
রাতের মধ্যে ফিরে আসা তাদের কাছে খুব বেশী কঠিন নয়।
ওরাই আমাদের সঙ্গে একজন লোক দিলেন।
সে ওখানকার নার্সারিতে কাজ করে। নাম রুবিয়া মুর্মু। বনক্ররমীর ভাষায় সে জঙ্গলের
কোণা কোণা চেনে।পাখির ডাক শুনে বলে দিতে পারে হাতী আছে কাছাকাছি। ওকে গাড়ীতে তুলে
নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। দুপাশে শালের টিক। মাঝে মাঝে কেন্দু, বহেড়া, মহুয়া। বড়
গাছের নীচে ছোট ছোট কুঁড়চি, পড়াশি আর ভুটরুর ঝোপ। জঙ্গলের ধারে ধারে ইউক্যালিপটাস,
আকাশমণি আর বাঁশের সারি।মাঝে কংসাবতী প্রোজেক্টের ক্যানেল। ক্যানেলের পাড় বরাবর
চওড়া রাস্তা। বড় বড় গাছের গায়ে পাক খেতে খেতে ঊপরে উঠে গেছে বুড়িলতা আর ঝুমকোলতা ।
কোথাও আবার আটাং ও বনলতার ঘোর অন্ধকার। বড় বড় গাছের মাথায় কুঁড়েঘরের মত ছাউনি।
একবিন্দু রোদ গলে না মাটিতে। ওখাকনেই হাতীর পাল দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকে। রাত হলে
নেমে যায় ধান বা ফসলের ক্ষেতে। মিস্টিগন্ধে তাকিয়ে দেখি বনলতা ফুলে ফুলে সেজে
উঠেছে। মউমাছির গুঞ্জনে মেতেছে বনানী।
রুবিয়া বলে---কালীপূজায় সময় লোতুন
ধান উঠলে এই লতার মালা পরিয়ে গরুর বিয়া হয়।
কন্যাটি আমার হেসেই অস্থির। রুবিয়া
বলে---হয় গো হয়। এটাই রীত। আমার বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে চলে আসছে। সেদিন এই লতা
গলায় পরিয়ে চাঁদকে সাক্ষী রেখে গরুর বিয়া হয়।
কন্যা কৌতুকে মাতে। আমি মাতি ফুলের
গন্ধে। বনের মাঝ দিয়ে গাড়ী এগিয়ে চলে। একটা খরগোশ রাস্তার এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে
পালায়। আমরা হাততালি দিয়ে উঠি। রুবিয়া হাসে। ওর কাছে এসব কিছু নয়।
একসময় সে আস্তে গাড়ী চালাতে বলে।
কারণ টা জানতে চাইলে মুখে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে বারণ করে। ইশারায় গাড়ী থামাতে বলে।
গাড়ী থামলে হাত দিয়ে দেখায়। দূরে ঘাসের মাঝে দুটো ময়ুর। ওরা হয়ত আমাদের অস্তিত্ব
বুঝতে পারল। মুহুর্তে হারিয়ে গেল ঘাসের আড়ালে। রুবিয়া বলল আমাদের ভাগ্য ভালো তাই
দেখতে পেলাম। জঙ্গলের কোথায় যে ওরা থাকে কেউ জানে না। হঠাৎ করে নজরে পড়ে কারো কারো
একটু এগোতেই দেখলাম ক্যানেলের পাড়
একটা জায়গায় ধ্বসে গেছে। জানলাম ওটা হাতীদের কান্ড। গতরাতে যাবার সময় এখানে ওরা
পার হয়েছে। নামলাম হাতীর পায়ের ছাপ দেখতে। কন্যার পিতৃদেব মজা করেন---এটা আড়াবাড়ি।
বেশী বাড়াবাড়ি কোরো না। উঠে এসো গাড়িতে।
আমরা উঠে আসি। আর একটু এগোতেই
জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক।
বউ-কথা-কও, বেনে-বউ, তিতির আরও কত
কি। পাতার আড়াল থেকে একটা মিস্টি শীষ ভেসে আসে। এদিক ওদিক দেখি। না কোথাও নেই।
রুবিয়া বলে –ওটা একটা পাখি। ওর নাম জানিনা। বিটবাবু বলে—বনপিয়া।
বাঃ! দারুণ তো ! ইচ্ছা হলে মনের মত
নামও দেওয়া যায়। পাপিয়া-মউপিয়াদের বনতুতো বোন।
মহুল গাছের পাতায় কুক্কুটের বাসা
দেখিয়ে রুবিয়া। বলে---কুক্কুটের ডিম খুব ভাল বাবু। একটুখানি ভাজা দিয়ে একথালা
পান্তা খাওয়া হয়ে যায়। সকালে পেড়ে লিয়ে গেছি এতোগুলোন।
আমি ওকে দেখি। সেই অরণ্যপুত্র!
জিজ্ঞাসা করি—তোমার বাড়ি কোথায়?
সে হাত দিয়ে দেখায়---হুঁই বাগে।
যাবেন গো আমাদের ঘর? বউটা খুশি হবে। কুক্কুটের ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খাওয়াব আর
হাড়িয়াও আছে এট্টুস।
কন্যা বলে---খাসা নিমন্ত্রণ।
তারপর সুর বদলে যায় তার---এই বন
একদিন আমাদের ছিল। শালের পাতা,মহুয়ার ফল-বীজ, কুসুম তেল, কেন্দুর পাতা-ফল, কুঁচি,
খেজুরপাতা...সব সব। এখন সরকারের, আমরা ওদের মজুর।
থমকে যাই। ওকে দেখি। অরণ্যের
অধিকার হারানোর ব্যাথা ওর দুচোখে।কিন্তু কি করে বোঝাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায়
রাখতে অরন্যেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
বন আরো গভীর হতে থাকে। মহুয়া,
বহেড়া, শাল, কেন্দু সবাই গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।সাথে হাত মিলিয়েছে জঙ্গলের লতারা।
এবার ফিরতে হবে। কোথাও কোন দলছুট থাকতে পারে। তাছাড়া এখানে নাকি ময়াল সাপ আর সজারু
ছাড়া হয়েছে। বর্ষায় ক্যানেলের জলে ভেসে যেতে দেখা গেছে। আর না। ফিরে চলো মন।
ফেরার রাস্তা ধরি। ফেরার পথে
রুবিয়া দেখায় পিকনিক স্পট। জঙ্গলের গায়ে পিকনিকের জায়গা।একটা ঝিল। কয়েকটা নৌকা
ভাসছে। ঝিলের মাঝ পর্যন্ত যাওয়ার সেতু।
একটা শীতের দিনে পিকনিক আর ঘুরে বেড়াবার জন্য আদর্শ জায়গা। সকাল সকাল একটা
গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লে মন্দ হয় না। সারাদুপুর ঘুরে ,পিকনিক করে ফেরা যায়। নাহলে
বিকালে ফিল্ম সিটি দেখে সোজা গড়বেতা। রাতে লজে কাটিয়ে পরের দিন গনগনির প্রাকৃতিক
দৃশ্য আর উপরিপাওনা সর্বমঙ্গলা মন্দির ও বগড়ী রাজাদের কিছু কির্তিকলাপ । খুঁজে
নেওয়া যাবে হারানো ইতিহাসের কিছু পাতা। সেসব কথা নাহয় পরে একদিন হবে।
স্টেট হাইওয়ের উপর দাঁড়িয়ে আর
একবার ফিরে তাকাই জঙ্গলের দিকে। বাতাসে দুলছে আকাশমণির পাতা। হাত নেড়ে বিদায়
জানাচ্ছে কি? কি জানি—হয়তো তাই। রুবিয়ার
ছেলেমেয়েকে মিঠাই খাবার জন্য কিছু দিতে যাই। সে নেয় না। বলে ---ফিরার পথে
নিমন্তন্ন সেরে যাস।
তাই হবে বলে গাড়িতে উঠে বসি। আবার
চলা শুরু---পিছনে পড়ে থাকে অরণ্য ও অরণ্যপুত্র।
Subscribe to:
Posts (Atom)